আশুলিয়ায় ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নানান অনিয়ম দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ

Loading

সাভার প্রতিনিধি: জমিদখল, সরকারী সম্পদ আত্মসাৎ, মাদক ব্যবসায় আশ্রয় প্রদান, অস্ত্রবাজি, গ্যাস সংযোগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত সাভার উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম সুরুজ।

এক সময়ের জাতীয় পার্টির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সুরুজ ২০০৩ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের ব্যানারে ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ক্ষমতাশীন দলের ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার এর থেকেই দখল বাণিজ্য, মাদক ব্যবসায় আশ্রয় দেওয়া ও নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে এলাকায় শুরু করেন আধিপত্য বিস্তার। তার ছত্রছায়ায় এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি দুর্ধর্ষ ক্যাডার বাহিনী। এই বাহিনী এলাকায় চেয়ারম্যান বাহিনী হিসেবে পরিচিত। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা, অস্ত্রবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ এই বাহিনীর বিরুদ্ধে।

এসব কর্মকান্ডের নেতৃত্বে রয়েছেন ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম (রবি)। চেয়ারম্যানের পালকপুত্র ও ডানহাত হিসেবে এলাকায় পরিচিত এই রবি। গত ১৬ জুন চাচাকে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসাতে গিয়ে বিদেশি পিস্তল ও কয়েক রাউন্ড গুলিসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন রবি। ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি রবির মাধ্যমে এলাকায় দখল বাণিজ্য, অধিপত্য বিস্তার, পতিপক্ষের লোকদের নির্যাতন ও গ্যাস সংযোগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন এই ইউপি চেয়ারম্যান।

তার লোকজনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জিরানী আমতলা সড়কে বিভিন্ন পরিবহন থেকে চাঁদা টাকা উত্তোলন করছেন ইউপি চেয়ারম্যানের ছোট ভাই আব্বাস পালোয়ান, সহযোগী মোতালেবসহ একটি চক্র। প্রতিটি ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে দিনপ্রতি অদায় করা হয় ৩০ টাকা, মহেদ্র পরিবহনকে গুনতে হয় দিনপ্রতি ১৫০ টাকা ও মাসিক ১৫০০ টাকা। বিভিন্ন সড়কে উত্তোলনকৃত চাঁদার পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় অর্ধলক্ষ টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এভাবে চাঁদাবাজি চলে আসলেও সম্প্রতি পরিবহন থেকে টাকা আদায়ের জন্য দেয়া হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের স্টিকার। তবে এসব স্টিকার প্রদান ও প্রতিদিন টাকা আদায়ের কাজটি করছেন চেয়ারম্যান পরিবারের সদস্যরাই।

শিমুলিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় কয়েক বছর আগে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়া হলে পরবর্তী বিভিন্ন সময় তিতাসের অভিযানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে বার বার এসব অবৈধ সংযোগের কারণে এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে গ্যাসের সংকট। প্রতি সকালে রান্নার কাজে বিরম্বনায় পড়তে হয় বৈধ সংযোগ ব্যবহারকারীদের। সম্প্রতি গ্যাস লাইনের রাইজারে গ্যাস সরবারহ বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলে চুলাপ্রতি ৪ হাজার টাকা করে ইউপি চেয়ারম্যান সুরুজের নামে আদায় করছেন ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য করিম চিশতী, মতি মোল্লা, আলী আহাম্মদ, দানেস বেপারীসহ একটি চক্র। এভাবে গ্যাসের সরবারহ বাড়িয়ে দেয়ার নামে শুরু হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়ার বাণিজ্য।

ইউপি চেয়ারম্যান ও তার পালিত সন্ত্রাসীদের কর্মকান্ডে অতিষ্ট হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষ। ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই ঘটছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড। এসব ঘটনায় স্থানীয় বখাটেদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করলেও কোন ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা উল্টো ভুক্তভোগীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডিম ও মুরগি সরবারহের ব্যবসা করেন তিনি। গত কয়েক মাস আসে রাঙ্গামাটি ব্রিজের পাশে স্টার ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারের সামনে তিনি ডাকাতির কবলে পড়েন। সেদিন ডিম ও মুরগি বিক্রি করে গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে এলাকায় ফিরছিলেন। পথে ডাকাতরা রাস্তায় গাছ ফেলে তার ট্রাকের গতিরোধ করে সাথে থাকা নগদ ২ লক্ষ ৭৬ হাজার টাকা ও দু’টি দামি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়।

তার চিৎকারে আশেপাশের লোকজন এসে ডাকাতদের হাতেনাতে ধরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম সুরুজের কাছে নিয়ে যায়। এসময় আটককৃত ব্যক্তিদের ডেকে নিয়ে আলাদা কথা বলার পর তাদের ছেড়ে দিয়ে চার দিন পর বিচার করা হবে বলে জানান চেয়ারম্যান। এরপর ঘটনার পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়ে গেলও বিচার তো দূরের কথা! হাতেনাতে ধরা পড়া ডাকাতদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া তার টাকা ও মোবাইল দু’টি আজও ফেরত পাননি বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী।

স্থানীয়রা জানান, ইউপি চেয়ারম্যান সুরুজের সহযোগী হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ নেতা রবির নিয়ন্ত্রণে চলছে এসব কর্মকান্ড। এলাকায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, উঠতি বয়সের কিশোর ও যুবকদের নিয়ে নিয়মিত মাদক সেবন করেন রবি। চেয়ারম্যানের কাছে বার বার এসব বিষয়ে নালিশ করেও প্রতিকার পাননা ভুক্তভোগীরা। একই স্থানে স্থানীয় বখাটেদের কাছে ডাকাতির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয় ফরহাদ বেপারী, কালু বেপারী, গোবিন্দ নিশিসহ অনেকেই।

গত ১৩ মে গোবিন্দ নিশির স্ত্রী বেতন নিয়ে বাসায় ফেরার সময় একই স্থান থেকেই টাকা ও মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় কয়েকজন যুবক। পরে জানতে পারেন তারা রবির লোকজন। এছাড়া কয়েক মাস আগে বিবাহের বরযাত্রীর পথরোধ করে ডাকাতরা ৭-৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ পাঁচ লাশ টাকা ছিনিয়ে নেয়- বলছিলেন ভুক্তভোগী গোবিন্দ নিশি।

তবে অস্ত্র মামলায় গত কয়েক মাস ধরে চেয়ারম্যানের সহযোগী ও ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি রবি জেল হাজতে থাকায় শিমুলিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় অনেকটাই শান্ত অবস্থা বিরাজ করছে। এই সময়ের মধ্যে ঘটেনি বড় কোন ডাকাতি বা অন্য তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা- বলছিলেন স্থানীয়রা।

শিমুলিয়া ইউনিয়নের অধিকাংশ রাস্তার অবস্থা জরাজীর্ণ। সড়কগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পরিণত হয়েছে ছোট-বড় খানাখন্দে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে রাস্তাগুলোর এখন বেহাল অবস্থা। রিকশা, ভ্যান ও মোটরসাইকেল আরোহীসহ পথচারীদের জন্য রাস্তাগুলোতে চলাচল যেন সীমাহীন দুর্ভোগের ব্যাপার। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার কারণে অধিকাংশ সড়ক ডুবে থাকে পানিতে। গত পাঁচ বছরে এই চেয়ারম্যানের সময়ে রাস্তাঘাটের তেমন উন্নয়ন না হওয়ায় চরম ক্ষোভ স্থানীয়দের। বেশিরভাগ সড়কের অবস্থাই জরাজীর্ণ হলেও জিরানী মাজার রোড থেকে নামাপাড়া মসজিদ পর্যন্ত সড়ক, কলেজ রোড থেকে ঢালীবাড়ি পর্যন্ত, মুসলিম টেক, মরিচ কাটা সড়ক এখন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

তার বিরুদ্ধে রয়েছে সরকারী উন্নয়নের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। গোয়াইল বাড়ি থেকে গাজীবাড়ী সড়কের নির্মাণ কাজে শ্রমিক ব্যবহার না করে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে সড়কের কাজ করান। গত পাঁচ বছরে তার ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ আসলেও রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোগত তেমন কোন উন্নয়ন না হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী। এছাড়া তার ইউনিয়নের পাশ্ববর্তী গাজীপুর জেলার অন্তর্গত কয়েকটি এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত কর বকেয়া থাকে। এসব কর মওকুফ করিয়ে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তার ইউনিয়ন পরিষদে ডেকে নিয়ে এসব বাড়ির মালিকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে।

গত ছয় মাস আগে শিমুলিয়া ইউনিয়নের রাঙ্গামাটি এলাকায় শুকাই চান, অনন্ত সরকার ও শান্তি সরকার নামের ৩ সংখ্যালঘু ব্যক্তির নামে রেকর্ডীয় ৪ একর ৩৩ শতাংশ জমি দখল করে নিজের নামে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন ইউপি চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম সুরুজ। পরে নিজেদের সম্পতি প্রকৃত মালিকরা উদ্ধার করলেও প্রতিনিয়ত চেয়ারম্যানের ভয়ে আতঙ্কিত ভুক্তভোগী সংখ্যালঘুরা।

এছাড়া চেয়ারম্যানের নামে সরকারী খালের জামি থেকে মাটি কেটে পাশ্ববর্তী ইটভাটায় বিক্রির অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় ফারুকসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে।

ছাত্রলীগ নেতা রবিসহ চেয়ারম্যানের নিজস্ব লোকদের চাঁদাবাজির আরেকটি বড় খাত বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানা। এক একটি কারখানা থেকে মাসপ্রতি সর্বনিম্ন এক লক্ষ টাকা থেকে শুরু করে মোটা অংকের চাঁদা আদায় করেন রবিসহ একটি চাঁদাবাজ চক্র। কারখানার ট্রেড লাইসেন্স প্রদানেও নেয়া হয় কয়েকগুণ বেশি অর্থ এমনটি অভিযোগ বিভিন্ন করাখানা মালিকদের।

শিমুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে এলাকাবাসী জিম্মি হয়ে পড়লেও ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননা। তার সহযোগী অস্ত্রধারী রবি এলাকায় আরেক আতঙ্কের নাম। তাকে ব্যবহার করেই মূলত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন ইউপি চেয়ারম্যান। এসব ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজহারুল ইসলাম সুরুজ বলেন, যারা অভিযোগ করছেন তারাই এসব কাজের সাথে জাড়িত। তবে অভিযোগ বিষয়ে সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে দেখা করে তার সাথে কথা বলতে বলেন।