একের পর এক সুবিধা সরকারি চাকুরেদের

Loading

বেতন বৃদ্ধি, বাড়ি-গাড়ি কিনতে ঋণসুবিধা, পদোন্নতি, অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারে নমনীয়তাসহ একের পর এক সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন ও পাচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা। প্রাপ্তির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ।

সর্বশেষ, নির্বাচন সামনে রেখে মঙ্গলবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৫ শতাংশ সরল সুদে গৃহনির্মাণ ঋণ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তা জানিয়েছে।

২০১৫ সালে বেতন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধির পর কখনো শূন্যপদ ছাড়াই পদোন্নতি, বিনা সুদে গাড়ি কেনার ব্যবস্থা, স্বল্প সুদে ফ্ল্যাট কেনা বা বাড়ি করার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। জাতীয় সংসদের সর্বশেষ অধিবেশনে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি আইন-২০১৮’ করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনের ওই ধারাটিকে বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী বলে উল্লেখ করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারণ, একই অপরাধে জড়িত হলে সাধারণ নাগরিক থেকে জনপ্রতিনিধি—সবাইকে অনুমতি ছাড়াই গ্রেপ্তার করা যাবে। আর অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হলে সরকারের অনুমোদন লাগবে।

অবশ্য বর্তমান ও সাবেক একাধিক আমলা প্রথম আলোকে বলেছেন, অনেক সময় সরকারি আদেশ বা আদালতের আদেশ কার্যকর করতে গিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হেনস্তা ও মিথ্যা মামলার শিকার হন। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকারি কাজ করার জন্য একধরনের সুরক্ষা থাকতে হবে। তাঁদের যুক্তি, অভিযোগপত্র গৃহীত হলে তো গ্রেপ্তার এবং দণ্ডিত হলে শাস্তিও দেওয়া যাবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, এ রকম গুরুত্বপূর্ণ একটি আইন স্বল্পমেয়াদি সংসদের শেষ অধিবেশনে তড়িঘড়ি করে অনুমোদিত হওয়ায় তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা সাময়িক সুবিধার জন্য কি না, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

বেতন বৃদ্ধি
বর্তমানে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, ব্যাংকসহ সব মিলিয়ে প্রায় ২১ লাখ কর্মচারী রয়েছেন। ২০১৫ সালে তাঁদের মূল বেতন গ্রেড ভেদে ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বাড়ানো হয়। নতুন কাঠামো অনুযায়ী, প্রথম গ্রেডে সর্বোচ্চ মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা (নির্ধারিত)। আর ২০তম গ্রেডে সর্বনিম্ন মূল বেতন ৮ হাজার ২৫০ টাকা। আগে সরকারি কর্মচারীরা সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা ও সর্বনিম্ন ৪ হাজার ১০০ টাকা মূল বেতন পেতেন।

এমপিওভুক্তরাও পেলেন বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির সুবিধা
সরকারের শেষ সময়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদেরও মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি এবং ২০ শতাংশ হারে বৈশাখী ভাতার সুবিধা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ১৫ নভেম্বর এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

পদ-পদোন্নতির সুবিধা
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ২০১২ সাল থেকে জনপ্রশাসনে ‘ঢালাও’ পদ ও পদোন্নতি দেওয়া শুরু হয়। ওই বছর সচিবদের এক ধাপ ওপরে ‘জ্যেষ্ঠ সচিব’ নামে জনপ্রশাসনে আটটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। এখন সরকারে ১১ জন জ্যেষ্ঠ সচিব রয়েছেন। পরে পুলিশের মহাপরিদর্শকের পদটিও জ্যেষ্ঠ সচিবের পদমর্যাদায় উন্নীত করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত (ডিউটি) পদ আছে ১২১টি। গত ৩০ আগস্ট এই পদের বিপরীতে ১৬০ জন যুগ্ম সচিবকে পদোন্নতি দেওয়ায় ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত এই পদে কর্মকর্তা হয়েছেন ৬১৪ জন। যুগ্ম সচিবের নিয়মিত পদ আছে ৪৩০টি। সম্প্রতি ১৫৪ জন উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়েছে। ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত এই পদে মোট কর্মকর্তা হয়েছেন ৭৫৯ জন। উপসচিবের নিয়মিত পদ আছে ১ হাজার ৬টি। এ পদের বিপরীতে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ১ হাজার ৬০৩ জন। এর মধ্যেই গত ২৪ অক্টোবর ২৫৬ জন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবকে পদোন্নতি দিয়ে উপসচিব করা হয়। এখন এই পদে কর্মকর্তার সংখ্যা হয়েছেন ১ হাজার ৭৮৯ জন।

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের মতো পুলিশ ক্যাডারেও সুপারনিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত পদ সৃষ্টি) পদ সৃষ্টি করে সম্প্রতি ২৩০টি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। একই সঙ্গে শূন্য থাকা আরও ৫টি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।

অন্যান্য ক্যাডারের একাধিক কর্মচারী অভিযোগ করেছেন, পুলিশ ও প্রশাসনে যেভাবে পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, তা অন্যান্য ক্যাডারের কর্মচারীদের দেওয়া হচ্ছে না। অবশ্য শিক্ষা ক্যাডারে প্রায়ই পদোন্নতি হচ্ছে। এ ছাড়া ১৩ নভেম্বর বিসিএস ইকোনমিক ক্যাডারকে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত করায় এখন এই ক্যাডারের কর্মকর্তারাও প্রশাসন ক্যাডারের মতো সুযোগ-সুবিধা পাবেন।

বাড়ি-গাড়ির সুবিধা
বেতন বৃদ্ধির কারণে সরকারি কর্মচারীরা খুশিই ছিলেন। তার ওপর শেষ সময়ে এসে তাঁদের আরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। এর পেছনে সংসদ নির্বাচন এবং নীতিনির্ধারকের পরিকল্পনা ছিল। আগে শুধু যুগ্ম সচিব পর্যন্ত কর্মকর্তারা গাড়ির সুবিধা পেতেন। সবাইকে গাড়ি দিতে না পেরে প্রথমে ২৫ লাখ টাকা করে, পরে তা বাড়িয়ে ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এখন উপসচিবেরাও গাড়ির জন্য সরকার থেকে সুদমুক্ত ৩০ লাখ টাকা করে ঋণ পাচ্ছেন। সম্প্রতি সরকার বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বোচ্চ ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণসুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করছে। গত সেপ্টেম্বরে এর সঙ্গে আরেকটি সুবিধা যুক্ত করা হয়। চাকরিরত অবস্থায় কোনো সরকারি কর্মচারী মারা গেলে ওই কর্মচারীর উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে সরকার আর ঋণের টাকার আসল, সুদ ও দণ্ডসুদ কিছুই ফেরত নেবে না। কোনো কর্মচারী পঙ্গু হয়ে অবসরে গেলেও একই সুবিধা পাবেন।

আবার যাঁরা পেনশনের পুরো টাকা তুলে নিয়েছেন, অবসরের তারিখ থেকে ১৫ বছর পার হলে তাঁদেরও মাসিক ভিত্তিতে আবার পেনশন দেবে সরকার। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্টও (বার্ষিক বৃদ্ধি) পাবেন তাঁরা। প্রবীণ নাগরিকদের এই সুবিধাটিকে অবশ্য অনেকেই ইতিবাচক বলছেন।

আরও সুবিধা
মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সব সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মচারীদের বাসায় আগে বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরী থাকলেও গত বছর সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, বাবুর্চি ও নিরাপত্তা প্রহরীর বদলে সচিবেরা এখন ১৬ হাজার করে প্রতি মাসে মোট ৩২ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। গত জুনে সচিবদের জন্য ৭৫ হাজার টাকা করে মোবাইল ফোন কেনা এবং ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ হিসেবে মাসে ৩ হাজার ৮০০ টাকা করে বিল দেওয়ার প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। আগস্ট থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের ১০ম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত কর্মচারীদের জন্য মাসিক ঝুঁকি ভাতা এবং একই মাসে পুলিশ পরিদর্শকদের জন্য ‘বিশেষ ভাতা’ চালু করা হয়।