গ্রামের নাম নার্সারী পাড়া। চারিদিকে বিভিন্ন প্রজাতির সবুজ সতেজ চারা। মাঝে মাঝে চোখ জুড়ানো বাহারি রঙের ফুলবাগান।
এ সৌন্দর্য কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেনি। কিছু লোকের হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছে সবুজের এ সমারোহ। তাদেরই একজন মোজাম্মেল হক। কামিল পাস এ যুবক চাকরি নামক সোনার হরিণের পেছনে না ছুটে শুরু করেন নার্সারী ব্যবসা। এ পেশায় আজ তিনি স্বাবলম্বী। নাম দেয়া হয়েছে ‘আল আমিন’ নার্সারী। মোজাম্মেল হক বড়পই নার্সারী পাড়া গ্রামের মৃত আক্কাস আলী মন্ডলের ছেলে।
মাত্র ১২০ টাকা পুঁজি নিয়ে এ পথে যাত্রা শুরু করেন মোজাম্মেল। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সাফল্যের সোনার হরিণটি হাতে পেয়েছেন তিনি। এখন তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। প্রায় ২০ বিঘার বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তুলেছেন নার্সারী। তার এ নার্সারীতে প্রতিদিন কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ জন শ্রমিকের। দৈনিক ২৫০ টাকা মজুরিতে এসব শ্রমিকরা সকাল ৭টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কাজ করেন।
নওগাঁর মান্দা উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দুরে এই গ্রামের অবস্থান। মৌজা বড়পই হলেও নার্সারী পাড়া নামেই এখন অধিক পরিচিত গ্রামটি। বর্তমানে পাড়ার অন্তত ৬০ জন ব্যক্তি এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন। প্রতিদিন কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ৩ শতাধিক শ্রমিকের। বেকারত্ব দুর হয়েছে আশপাশের আরও অনেকের।
নার্সারী ব্যবসায়ি মোজাম্মেল হক জানান, ১৯৯৪ সালে আমার বাবা আক্কাস আলী মারা যান। তখন আমি রেবা আখতার আলিম মাদরাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করি। এর দুইবছর পর আমার দু’ভাই আব্দুর রাজ্জাক ও আব্দুল মালেক পৃথক হয়ে যান। বাবা মারা যাওয়ার আগে অন্য দু’ভাইও পৃথকভাবে সংসার করছিলেন। পৈত্রিকসুত্রে বসতবাড়িসহ সাড়ে ৫ কাঠা জমি অংশপ্রাপ্ত হই। এ অবস্থায় মা মতিজান বিবিকে নিয়ে আমি দিশোহারা হয়ে পড়ি। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
মোজাম্মেল হক বলেন, মাত্র ১২০ টাকা পুঁজি নিয়ে জীবন-যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। ভগ্নিপতি হায়দার আলীর নিকট থেকে দেড় শতক জমি একবছর পরে পরিশোধের চুক্তিতে ১৫০০ টাকায় লীজ নিয়ে পেঁপের চারা তৈরির কাজ শুরু করি। লেখাপড়ার পাশাপাশি গ্রামের অন্য নার্সারীতে শ্রম দিয়ে আয়ের টাকায় সংসার চালিয়ে নিই। এভাবেই অভাব-অনটনের মধ্যে ২০০১ সালে দাখিল পাস করি। এরপর পরানপুর মাদরাসা থেকে আলিম, বড়বেলালদহ মাদরাসা থেকে ফাজিল ও নওগাঁর নামাজগড় মাদরাসা থেকে কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। ২০০১ সালে দাখিল পাসের পর একটি এনজিও’র মাধ্যমে নার্সারী বিষয়ে ময়মনসিংহ হর্টিকালচারে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।
শিক্ষা ও মেধা কাজে লাগিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে গাছের পরিচর্যা করতে থাকি। অল্পদিনের মধ্যেই এর সুফল আসতে শুরু করে। এরপর বাৎসরিক চুক্তিতে জমি লীজ নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটনা তিনি।
সরজমিনে মোজাম্মেলের নার্সারীতে গিয়ে নতুন জাতের বেশকিছু আম গাছের চারা দেখা গেছে।
তার নার্সারীতে রয়েছে ব্যানানা ম্যাংগো, আম ব্লাডস্টোর, গৌড়মতি, বারি-৪, হাইব্রিড রুপালী, হাড়িভাঙা, নাগফজলিসহ অন্তত ৩০ জাতের আমের চারা। এছাড়া ৫ জাতের কমলা, বারি মাল্টা-১, ৩ জাতের লেবু, থাই, চায়না, ভেডিগেড, পলি, মাধবিলতাসহ ৭ জাতের পেয়ারা, ৪ জাতের লিচু, বেদেনা আনার, কেরালা, ভিয়েতনাম, সুনরি ও দেশিজাতের নারকেল, লটকনসহ অনেক দেশিয় ফলদ গাছে চারা রয়েছে। অন্যদিকে মেহগনি, আকাশমনি, বেজিয়ামসহ অনেক প্রজাতির বনজ চারা রয়েছে এই নার্সারীতে (০১৭১৯-৮৬৫৯৩৭ মোজাম্মেল )।
এছাড়া এখানে পাওয়া যাবে ১০ জাতের গোলাপসহ বিভিন্ন ফুলের চারা। বর্তমানে প্রায় ২০ বিঘা জমির বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই নার্সারী। এটিই নওগাঁ জেলার বৃহত্তম নার্সারী বলে জানিয়েছে সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষ।
নার্সারী ব্যবসায়ি মোজাম্মেল হক জানান, ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যায় আমার নার্সারী পুরোটাই পানিতে তলিয়ে যায়। পানির নিচে তলিয়ে থাকায় ছোট চারাগুলো নষ্ট হয়ে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। সেই ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারিনি। এছাড়া গত মৌসুমে ইটভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় জলপাই, আমড়া ও কাঁঠালের ৪ হাজার চারা নষ্ট যায়। এ বিষয়েও কোনো প্রতিকার পাইনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, বন্যায় ক্ষতির পরও কৃষি দপ্তর থেকে কোনো সহায়তা দেয়া হয়নি। নার্সারী পরিচর্যার ক্ষেত্রেও সহায়তা মিলে না কৃষি দপ্তরের। মিলে না সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও। এই নার্সারী মালিক দাবি করেন, কৃষি অফিসের সহায়তা ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই পেশাকে আরও গতিশীল করা সম্ভব। তৈরি হবে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান।