দুই বাংলার মধ্যে কোন কাটাতারের বেড়া চাই না- পশ্চিমবঙ্গের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতি প্রিয় মল্লিক
আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবসে বেনাপোল নোম্যান্সল্যান্ড এলাকায় বসেছে দু‘বাংলার হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষের মিলন মেলা ।
একই আকাশ একই বাতাস, দুই বাংলার মানুষের ভাষা এক। একই নদী একই জল’ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি বলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমাদের প্রাণ কাঁদে। তাই তো বারবার ছুটে আসি দুই দেশের বাঙালী বাংলাভাষী মানুষের পাশে। ভাষা দিবস মিলিয়ে দিল ‘এপার-ওপার’। বাঁশের বেড়া উপেক্ষা করে ভাষার দাবিতে আন্দোলনে শহীদদের সম্মিলিত শ্রদ্ধা জানাল ভারত-বাংলাদেশ।
ভৌগলিক সীমারেখা ভুলে কেবলমাত্র ভাষার টানে দু‘বাংলার মানুষ একই মঞ্চে গাইলেন বাংলার জয়গান। ”আমার প্রতিরোধ আমার সংগ্রাম আমার স্বাধীনতা আমার অধিকার আমার ৫২ আমার বর্নমালা” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে এপার ওপার দুই বাংলার একুশ উদযাপন পরিষদের আয়োজনে মহান শহীদ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস যৌথ ভাবে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এবারও পালন করেছে এক সঙ্গে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে। বৃহস্পতিবার সকালে এভাবেই কাটালেন দুই বাংলার ‘বাংলা ভাষাভাষী’ মানুষ। সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে শহীদ বেদি ঢাকল ফুলের চাদরে।
বেনাপোল চেকপোস্ট নোম্যান্সল্যান্ডে স্থাপিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে প্রতি বছরের মতো এবারো ভাষা শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হলো। মিষ্টি বিতরণ, আলোচনা আর গানে গানে মাতোয়ারা হলো দুই বাংলার একই আকাশ একই বাতাস। উভয় দেশের জনপ্রতিনিধিরা বলেন, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা। এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে জড়ো হয়েছিল হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ। নেতাদের কণ্ঠে ছিল ভবিষ্যতে আরো বড় করে এক মঞ্চে একুশসহ অন্যান্য অনুষ্ঠান উদযাপনের প্রত্যাশা। উভয় দেশের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো শত:স্ফুর্তভাবে অংশ নেয় এ অনুষ্ঠানে। দু‘দেশের জাতীয় পতাকা, নানা রং এর ফেস্টুন, ব্যানার, প্লেকার্ড, আর ফুল দিয়ে বর্নিল সাজে সাজানো হয় নোম্যান্সল্যান্ড এলাকা। দু‘বাংলার মানুষের এ মিলন মেলায় উভয় দেশের সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয়। প্রতি বছরই দুই বাংলার সীমান্তবর্তী এ অংশের বাসিন্দারা এক সাথে মিলিত হয়ে দিবসটি পালন করেন। তখন দুই দেশের সীমান্তের মধ্যবর্তী ওই স্থানে আবেগাপ¬ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। একে অপরকে আলিঙ্গন করে সকল ভেদাভেদ যেন ভুলে যায় কিছু সময়ের জন্য। ফুলের মালা ও জাতীয় পতাকা বিনিময় করে উভয় দেশের আবেগপ্রবণ অনেক মানুষ বাঙালীর নাড়ির টানে একজন অপরজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। দুই বাংলার মানুষের মাঝে বসে এক মিলন মেলা। এ সময় পেট্রাপোল ও বেনাপোল চেকপোস্টে ঢল নামে হাজার হাজার মানুষের। ক্ষনিকের জন্য হলেও স্তব্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক সীমারেখা।
সকাল ১১ টায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী শ্রী জ্যোতি প্রিয় মল্লিক, বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস ও বনগাঁ পৌর মেয়র শংকর আঢ্যর নেতৃত্বে ভারত থেকে আসা শতশত বাংলাভাষী মানুষ বাংলাদেশীদের ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে ও মিস্টি দিয়ে বরণ করে নেয় একে অপরকে। নোমান্সল্যান্ডে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ভারতের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, বঁনগা লোকসভার সাংসদ শ্রীমত্যা মমতা ঠাকুর, উত্তর ২৪ পরগণা জেলা পরিষদের সভাধিপতি শ্রীমতি বীনা মন্ডল, বিধানসভা বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস ও বনগাঁও পৌর সভার মেয়র শংকর আঢ্য। বাংলাদেশের পক্ষে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্রাচার্য্য, যশোর-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব শেখ আফিল উদ্দিন, কাস্টমস কমিশনার বেলাল হোসেন চৌধুরী, ৪৯ বিজিবির ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মেজর নজরুল ইসলাম, একুশ উদযাপন পরিষদের আহবায়ক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মঞ্জু, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক আলহাজ¦ নুরুজ্জামান।
ভাষা দিবসের মিলন মেলায় বিজিবি বিএসএফকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। এর পর দু’দেশের জাতীয় পতাকা উড়িয়ে হাজার হাজার ভাষাপ্রেমী মানুষ দিবসটি উদযাপন করে যৌথভাবে। এ সময় ভাষার টানে বাঙালির বাঁধন হারা আবেগের কাছে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় দু‘বাংলার মানুষ। এর মধ্য দিয়ে বোঝা গেল রফিক, শফিক, বরকত ও সালামের তরতাজা রক্ত বৃথা যায়নি। ভাষার আকর্ষণ ও বাঙালির নাড়ির টান যে কতটা আত্মিক ও প্রীতিময় হতে পারে তাও বুঝিয়ে দিল মহান একুশে ফেব্রæয়ারি। সেই সঙ্গে এপার-ওপার দুই বাংলার গণমানুষের ঢল ফের প্রমাণ করে দিলো দেশ ভাগ হলেও ভাগ হয়নি ভাষার। উভয় দেশের মধ্যকার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত্তি এখনো যে অটুট রয়েছে তাও বোঝা গেল অনুষ্ঠানে উপস্থিত দুই বাংলার অতিথিদের বক্তৃতায়। এরপর একুশ মঞ্চে উঠেন দু‘দেশের নেতৃবৃন্দ।
বেনাপোল একুশ উদযাপন পরিষদের আহবায়ক উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম মঞ্জুর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লি¬ক বলেন, আমি বাংলায় কথা বলি পুন: জন্মে আমি বাঙালী হয়ে জন্মাতে চাই। কাটাতারের বেড়া আমাদেরকে আটকাতে পারে কিন্ত আমাদের আবেগকে আটকাতে পারবে না। আমরা হয়ত থাকবো না। আগামীতে কোন কাটাতারের বেড়া থাকবে না। দু‘বাংলা এক হয়ে যাবে। দুই বাংলার কত বাঙালী জন্ম গ্রহণ করেছে সবাই বাংলায় কথা বলেন। দুই বাংলায় কত নামী দামি কবি সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি নজরুল ইসলাম, শরৎচন্দ্র চট্রোপাথ্যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, শেখ মুজিবর রহমান। ভাষার জন্য রফিক সালাম বরকত শফিক জীবন দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নিজের জীবন দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে একটি ভ‚খন্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারই যোগ্য কন্যা বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী আমাদের কাছের মানুষ। ভাষা আর স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগের নজির পৃথিবীতে অন্য কারোর নেই। ভাষার টানে আমরা বাংলাদেশে ছুটে এসেছি একুশ উদযাপন করতে। দু‘বাংলার মানুষ একসাথে মাতৃভাষা দিবস পালন করছি। দু‘বাংলার মানুষের মিলন মেলার মধ্য দিয়ে দু‘দেশের বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হবে। আগামীতে আরো বড় পরিসরে একুশে অনুষ্ঠান হবে বলে তিনি জানান।
তিনি সম্প্রতি ঢাকার চকবাজারে আগুনে পুড়ে ৮১ জনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন তাদের পাশে থাকতে না পারলেও দুর থেকে সমবেদনা জানাচ্ছি।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্রাচার্য্য বলেন, দুই বাংলার মানুষ আজ আমরা এক হয়েছি। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন আমাদের অধিকার বোধের জম্ম দিয়েছিল। সালাম, বরকত, রফিক, শফিক জব্বারসহ হাজারো মানুষের রক্তের বিনিময়ে রাস্ট্রভাষার যে অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বিশ্বে বিরল। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা পেয়েছি ভারত বাংলাদেশের মানুষের রক্তের বিনিময়ে। আজকের সেই বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে সারা বিশ্বে। সেই চেতনার ধারাবাহিকতায় আজ দুই বাংলার বাঙালীরা এক মঞ্চে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে। ভাষা ও ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের দুই দেশের মধ্যে উপস্থিত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিতকে আরো শক্ত করবে।
মঞ্চে স্মৃতি চারণ করেন বাংলাদেশের ভাষা সৈনিক শামসুল হুদা। একুশের গানসহ বিভিন্ন ধরনের গান পরিবেশন করেন ভারতের সারেগামার বাংলাদেশের শিল্পী মাঈনুল আহসান নোবেল, পৌষালী ব্যানাজীসহ ভারত বাংলাদেশের শিল্পীরা।
ভাষা শহীদদের স্মরনে দু’বাংলার মানুষের স¤প্রতি আর ভালোবাসার বাধনকে আরো সুদৃঢ় করার প্রত্যয় নিয়ে শেষ হয় ভাষা প্রেমিদের মিলন মেলা। সমগ্র অনুষ্ঠানে নেয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা। কড়াকড়ি আরোপ করা হয় দুই সীমান্তে। বেনাপোল পেট্রাপোল চেকপোস্টে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য বিজিবি ও বিএসএফ অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করে দুই সীমান্তে। সীমান্ত টপকে যাতে কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য বিজিবি ও বিএসএফ বাঁশের বেস্টনি দিয়ে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ২০০২ সাল থেকে দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল চেকপোস্টের জিরো পয়েন্টে মাতৃভাষা দিবস পালন করে আসছে দু‘বাংলার মানুষ। এছাড়া আয়োজনস্থলে বর্ণমালা গ্যালারি, বইমেলা ও বাংলাদেশের একশ’ স্বেচ্চাসেবী স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেন। যা ভাষা উৎসবকে প্রাণবন্ত এবং দুই বাংলার মানুষকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে।