বাংলাদেশ (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ৯৯ তম জন্মদিন

Loading

এ আর আহমেদ হোসাইন,কুমিল্লা জেলা প্রতিনিধি ঃ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত মুজিবনগর সরকারের অন্যতম উপদেস্টা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সভাপতি, এদেশের বাম আন্দোলন এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যাক্তিত্ব প্রয়াত অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ’র আজ ৯৯ তম জন্মদিন। চলমান করোনা বিপর্যয়ের কারণে কোনো আনুষ্ঠিকতা ছাড়াই প্রয়াত হবার পর তাঁর প্রথম জন্মদিনটি উদযাপিত হলো অনাঢ়ম্বরে।তিনি ১৯২২ সালের ১৪ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার উপজেলার এলাহাবাদ গ্রামের সম্ভ্রান্ত ভুইয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ হোসেনতলা স্কুল, জাফরগঞ্জ রাজ ইনস্টিটিউশন, দেবীদ্বার রেয়াজউদ্দিন পাইলট উচ্চবিদ্যালয় ও ভিক্টোরিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সসহ এমএ ডিগ্রি পরে ইউনেস্কোর ডিপ্লোমা অর্জন করেন। চাকুরী জীবনে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন তিনি।

চল্লিশের দশকে ‘পাকিস্তান উন্মাদনার’ বিপরীতে যে মুষ্টিমেয় মুসলমান তরুণ ছাত্রাবস্থায় বামপন্থায় দীক্ষা নিয়েছিলেন, মোজাফফর আহমদ তাঁদের একজন। নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সন্দ¦ীপের সন্তান কমরেড মোজাফফর আহমদকে। ১৯৫১-৫২ সালে যখন ভাষা আন্দোলন হয়, তখন মোজাফফর আহমদ ঢাকা কলেজের শিক্ষক। তাঁর আজমপুরের ৮/আই কলোনির বাসায়ই কমিউনিস্ট নেতারা নিয়মিত বৈঠক করতেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন নেপাল নাগ, খোকা রায়, অনিল মুখার্জি, সত্যেন সেন। তিনি নিজেও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এরপর মোজাফফর আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী মফিজ উদ্দিন আহাম্মদের মতো শক্তিশালী প্রার্থীকে হারিয়ে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। নিজেকে পরিচিত করে তুলেন কুঁড়েঘরের মোজাফফর হিসেবে। পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হিসেবে মোজাফফর আহমদ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখেন।

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হলে তিনি এর কেন্দ্রীয় নেতা হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে মোজাফফর আহমদের নামে হুলিয়া জারি হয় এবং তিনি আত্মগোপনে চলে যান। এর আগেই তিনি নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ বিভক্ত হলে মস্কোপন্থী অংশের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতির দায়িত্ব নিতে হয় তাঁকে। মুক্তিযুদ্ধকালে মোজাফফর আহমদ মুজিবনগর সরকারে এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে নিলেও মনে করতেন, আওয়ামী লীগ যেখানে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম শেষ করবে, সেখান থেকেই বামপন্থীদের যাত্রা শুরু হবে। সে লক্ষে ন্যাপ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে (সিপিআই) দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ভূমিকা নিশ্চিত করে। ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় পৃথক গেরিলা বাহিনী। মোজাফফর আহমদের সম্পাদনায় নতুন বাংলা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশিত হয় মুজিবনগর থেকে। ১৯৭৯ সালের সংসদে নির্বাচিত হয়ে তিনি সমাজতন্ত্রের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন। আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এই প্রবীণ রাজনীতিক ১৯৮১ সালে ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ও একতা পার্টির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।

আওয়ামী লীগ সরকার মোজাফফর আহমদকে স্বাধীনতা পদক দেওয়ার ঘোষণা দিলে তিনি সবিনয়ে সেটি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেছিলেন, তিনি কোনো পুরস্কারের জন্য রাজনীতি করেননি। মানুষের ভালোবাসাই তাঁর পুরস্কার।
তিনি রাজনৈতিক কারনে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, অস্ট্রিয়া, ভারত, দক্ষিণ ইয়মেন, লিবিয়া, আফগানিস্তান, মধ্যপ্রাচ্যসহ পূর্ব ও পশ্চিম ইউরোপের বহু দেশ সফর করেন।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ রচনা করেন ‘সমাজতন্ত্র কি এবং কেন’, ‘প্রকৃত গণতন্ত্র তথা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে জানার কথা’, ‘মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র ও কিছু কথা’ নামে রাজনীতি ও জীবনী মূলক একাধিক মূল্যবান বই।

অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের জন্মদিনটি চলমান করোনা বিপর্যয়ের কারনে উদযাপনের কোনো আয়োজন না থাকলেও ন্যাপ কেন্দ্রীয় সম্পাক মন্ডলীর সদস্য অনিল চক্রবর্তির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় ন্যাপ, দেবীদ্বার উপজেলা ন্যাপ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, এলাহাবাদ মহাবিদ্যালয়, এলাহাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় ও বিভিন্ন সংগঠন মহান এ নেতার সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।