সাভারে নানা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে শিশুরা
রোদেয়ান হাসান, সাভার: সাভারে গ্যাং কালচারের নামে ভয়ংকর হয়ে উঠছে উঠতি বয়সের কিশোররা। সম্প্রতি সাভারের বিভিন্ন এলাকা ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য মারামারি, অস্ত্র প্রদর্শন, শো-ডাউনসহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকান্ড সাথে চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
এদের সবচেয়ে ভয়ংকর কিশোর গাংটি হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও পাশ্ববর্তী এলাকা থেকে পরিচালিত ব্রাদারহুড নামের একটি কিশোর দল। যার নেতৃত্বে রয়েছে জাবি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক শহিদুল ইসলামের ছেলে মিরাজ ওরফে ফারভিদ মিরাজ। দলবেঁধে বিভিন্ন স্থানে বসে আড্ডা দেওয়া, ইভটিজিং করা, এমনকি মাদক সেবনের মতো অপরাধের সাথে যুক্ত এর সদস্যরা। এই গ্যাংটির সক্রিয় সদস্যরা হলো- ইশতিয়াক আহমেদ রুদ্র, আরিয়ান তাহসিন তূর্ণ, সালমান হোসেন রাতিন, রাকিব হোসেন, শারাফ শাফিন ইমন, মোতাহের হোসেন তাসিম প্রমুখ।
বাইরে থেকে জাবি ও আশেপাশের এলাকায় ঘুরতে আসা কেউ ঠিকঠাক মতো তাদের ম্যানার না মানলে, তাদের সামনে সিগারেট খাওয়াসহ কোন ভুল করলে ‘ব্রাদাহুড’র ছেলেদের কাছে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্য এলাকা থেকে অপরিচিত কেউ ঘুরতে আসলে তাদের কৌশলে আটকে রেখে মোবাইল, টাকা-পয়সাসহ জিনিসপত্র রেখে দেয় তারা। এছাড়া জাবি স্কুল এন্ড কলেজের মাঠে বসে নিয়মিত মাদক সেবন করে এই গ্রুপের সদস্যরা। গত বছর নাহিদ নামে এক সহপাঠিকে অপরহণ করে মিরাজ ও তার গ্যংয়ের সদস্যরা। পরে ১০ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহয়তায় উদ্ধার করা হয় নাহিদকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংলগ্ন আমবাগান এলাকা থেকে তাদের গ্যাংটি গড়ে উঠলেও সম্প্রতি সাভারের বিভিন্ন পাড়া মহল্লা গিরে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করছে ব্রাদারহুড গ্যাং। ফেসবুকে গ্রুপ খুলে বিভিন্ন এলাকার কিশোরদের নিজেদের দলে ভেড়াচ্ছে তারা। এছাড়া ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদের দলে যোগদান কারিয়ে সংঘটিত হয়ে বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় আশেপাশের এলাকা থেকে তাদের ছেলেদের নিয়ে এসে আধিপত্য দেখায় কিশোর গ্যাংটির সদস্যরা।
ব্রদারহুড নামের এই কিশোর সন্ত্রাসী গ্রুপের রেডিও কলোনি এলাকার নেতৃত্ব দেয় রাবিয়ান আহমেদ ইমন, আজনান আহমেদ, ইমন মোল্লা, মাহফুজ ফরাসি। উলাইল এলাকায় রাহাত ফাতেহ, কলমা এলাকায় মোহাম্মদ ও হাসান মাহমুদ, জিরানী এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে অপু মুন্সি ও আবির আহমেদ এবং বাইশমাইল এলাকায় সাবাব চৌধুরী ও শেখর শেখ। এছাড়া সাভারের পাশ্ববর্তী উপজেলা ধামরাইয়েও সংগঠিত হচ্ছে এই কিশোর গ্যাংটি। সেখানে নেতৃত্ব দেয় নাবিলুর রহমান অয়ন, রাইয়ান আহমেদ ও ইমতিয়াজ আহমেদ মিঠু।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ্ববর্তী কলাবাগান এলাকায় উজ্জল সিয়ামের নেতৃত্বে রয়েছে আরেকটি কিশোর গ্যাং। আবুু সুফিয়ান আকাশ, কামরুল হাসান রনি ও সবুজ ইসলাম বাবুসহ এলাকার শতাধিক উশৃঙ্খল কিশোর এই গ্রুপের সদস্য। যারা নিজেদের ‘ডিফারেন্ট বয়েজ’ নামে পরিচয় দিলেও জিআই পাইপ নিয়ে তারা চলাফেরা করে বলে এলাকায় ‘জিআই পাইপ’ গ্রুপ নামেই তাদের পরিচিতি। এই গ্যাংয়ের বেশীরভাগ সদস্যই জাবির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের সস্তান।
এই ‘জিআই পাইপ’ এর সদস্য আবু সুফিয়ানকে সিনিয়র হিসেবে সম্মান না করায় শান্ত সরকার নামে এক ছাত্রকে রড, জিআই পাইপ দিয়ে পিটিয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের জঙ্গলে ফেলে রেখে যায় গ্যাংটির সদস্যরা। এঘটনায় সুফিয়ান, উজ্জল, বাবুসহ ৬ জনকে আটকের পর তখন তাদের কাছ থেকে জিআই পাইপ, ইয়াবা সেবনের কয়েন ও ফয়েল পেপার উদ্ধার হয়েছিল বলে জানায় বিশ^বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা অফিস।
গাঁজা সেবনে আসক্ত কিশোর গ্যাং মুন্সি সাদাফ
অন্যদিকে সাভার পৌর এলাকার ৮নং ওয়ার্ডে কিশোর জগতের ভয়ংকর এক অপরাধীর নাম সায়েম রহমান সাদাফ ওরফে মুন্সি সাদাফ। এলাকার দাপট ব্যবহার করে তার নেতৃত্বে রয়েছে একটি কিশোর গ্যাং। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, বুন্ধদের নিয়ে মাদক সেবন, চুরি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত এই গ্যাংটির সদস্যরা। স্কুল পড়–য়া উঠতি বয়সের কিশোরদের নিয়ে পরিবারের অজান্তেই মাদকসহ নানা অপকর্মের সাথে সম্পৃক্ত করার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এছাড়া ছাত্রলীগের কোন কমিটিতে নাম না থাকলেও ছাত্রলীগ নেতা পরিচয়ে এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায় সে।
এদের ছত্রছায়ায় রাজাশনের ঈদগাহ মাঠ এলাকায় দাপিয়ে বেড়ায় ফাতিন, সজিব, সুজন। যাদের মধ্যে সজিব মাদক ব্যবসায়ী আর সুজনের নেতৃত্বে প্রতি সন্ধ্যায় এলাকার সুফিয়া বেকারীর মোড়ে মাচার ওপর বসে মাদক সেবনের আসর। রাজাশন গ্যারেজ এলাকায় মিঠু ও ঘাসমহল এলাকায় হৃদয় নামে আরেক কিশোর উঠতি বয়সের ছেলেদের কাছে টাকা বিনিময়ে সরবারহ করছে গাঁজা, হোরোইনসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। আভিযোগ রয়েছে ৮নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবকলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন ওরফে জামাই আনোয়ার প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকায় তার কাছ থেকে সহজেই মাদক কিনছেন উঠতি বয়সের কিশোররা।
সাভারের রেডিও কলোনি এলাকায় শ্রাবণের নেতৃত্বে রয়েছে একটি কিশোর আপরাধী দল। এলাকার বন্ধুরা মিলে একসাথে গাঁজা সেবন, ছিনতাইসহ নানা অপরাধের সাথে যুক্ত তারা। সাভারের জামসিং বাটপাড়া এলাকার আলোচিত একটি হত্যাকান্ডেরও আসামী শ্রাবনসহ তার গ্রুপের সদস্যরা।
গত বছরের ১ মার্চ সাভারের সিআরপি চাপাইন এলাকায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বন্ধুদের ছুরিকাঘাতে খুন হয় ৮ম শেণির ছাত্র সোহাগ হোসেন। সেদিন বিকেলে বন্ধুরা মিলে একসাথে সিআরপির ভেতরে মেলায় ঘুরতে যায়। সন্ধ্যার কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তার পিঠে ধারালো ছুড়ি ঢুকিয়ে রক্তাক্ত করে পালিয়ে যায় মিঠু ও প্রান্ত নামে তার অপর দুই বন্ধু। পরে সোহাগকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এভাবে একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকান্ড জড়িয়ে পড়ছে সাভারের বিভিন্ন এলাকার কিশোররা। উঠতি বয়সের এসব কিশোরদের ভয়ে প্রতিবাদের সাহস পাননা এলাকার বড়রাও। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়া এই কিশোরদের নিয়ন্ত্রণে অবিলম্বে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে এলাকাবাসী। তা না হলে এক অনিশ্চিত ভবিৎষতের দিকে এগিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্ম।
এব্যাপারে সাভার উপজেলা শিশু সুরক্ষা ও মনিটরিং কমিটির সদস্য পারভীন ইসলাম বলেন, সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে এসব অসামাজিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। প্রতিটি পরিবাকে শিশু-কিশোরদের পরিচর্যায় আরও সচেতনতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া কিশোর আপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টিতে সমাজের সচেতন মহলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।