নওগাঁয় প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে বদলী বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। জ্যেষ্ঠতার ভিত্তীতে বদলী করার নিয়ম থাকলেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বদলী করা হয়েছে। অপরদিকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে বদলীকৃত আবেদন স্বাক্ষর করতে মিষ্টি খাওয়ার নামে শিক্ষকদের গুনতে হচ্ছে টাকা। অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলামসহ বিভিন্ন উপজেলার বদলী সংক্রান্ত দায়িত্বে থাকা কর্মচারীদের মাধ্যমে এ টাকা যাচ্ছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের পকেটে। শিক্ষকরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে।
জানা গেছে, প্রতি বছরের জানুয়ারী থেকে মার্চ মাসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়মিত বদলী হয়ে থাকে। এ বছরের গত ৩১ মার্চ নিয়মিত বদলী হয়ে গেল। আর এ বদলীতে নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার ‘২নং শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ সহকারী শিক্ষক আব্দুল মতিন। বাড়ি একই উপজেলার বারাতল গ্রামে। তিনি রাজস্ব খাতে ১৬/০৬/২০০৩ ইং তারিখে উপজেলার ‘ব্যাশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ যোগদান করেন। সেখানে ২ বছর অবস্থান করে ‘ভরট্ট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ বদলি হন। এরপর ৩/৪/২০১২ ইং তারিখ থেকে এখন অবধি ‘২নং শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ চাকরি করছেন।
গত ২/০১/১৯ ইং তারিখে উপজেলার ‘মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ যাওয়ার জন্য আবেদন করলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সেটি গ্রহণ করেননি। অথচ ২০০৭ সালে চাকরিতে যোগদান করা জুনিয়র শিক্ষক মাকসুদা খানমকে সেখানে বদলী করা হয়েছে।
এরপর সুযোগমত বদলগাছি মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হবে বলে আব্দুল মতিনকে আশ্বস্থ করেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। সেখানে তিনটি পদ শূন্য রয়েছে। শূন্য পদের বিপরীতে ১৫/০১/১৯ ইং তারিখে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশ নিয়ে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন তিনি। আর এ শূন্য পদের বিপরীতে ফয়জাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষক অনিল কুমার এবং জিধিরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সানিয়া মির্জাকে আবেদনের প্রেক্ষিতে মার্চ মাসে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। কিন্তু আব্দুল মতিনকে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলি করা হবে দিচ্ছি দিবো বলে কাল ক্ষেপন করেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।
অপরদিকে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অপর একটি শূন্য পদের বিপরীতে গত ২৮/০৩/১৯ ইং তারিখে গোবরচাপা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে নুরুন নাহার নামে এক শিক্ষক বদলির জন্য আবেদন করলে স্থানীয়রা আপত্তি জানালে সেটি ফেরত দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তিতে আবারও তিনি আবেদন করলে সেটি গ্রহণ করেন শিক্ষা কর্মকর্তা। ২/০৩/২০০৩ ইং তারিখে নুরুন নাহার প্রকল্প থেকে চাকরিতে যোগদান করেন। এরপর ২০০৭ সালে রাজস্বে আসে।
মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষক আব্দুল মতিন বার বার শিক্ষা কর্মকর্তাকে তাগাদা দিলে তার কাছ থেকে শিক্ষা কর্মকর্তার ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করেন। দাবীকৃত টাকা দিতে অস্বীকৃত জানালে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে নুরুন নাহারকে মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদীল করা হয়।
২০০৯ সালে সহকারী শিক্ষক পদে নাহিদা সুলতানা নিয়োগ পেয়ে তেঘরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি কোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়া জন্য এবছর শিক্ষা অফিসে আবেদন করেন। কিন্তু তার আবেদন মঞ্জুর না করে ২০১১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত কয়াভবানিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক উম্মে আতিয়াকে কোলা স্কুলে বদলী করা হয়।
গয়েশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মাহমুদা খাতুন বদলির আবেদন করেছিলেন ‘২নং শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ শুন্য পদে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তাকে ওই স্কুলে বদলি না করে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার ‘বনগাঁ চক-রহমত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের’ শিক্ষক মিতালী কিসকুকে শেরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ নিয়ে আসার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। মিতালী কিসকু রবিবার (৩১ মার্চ) স্কুলে যোগদান করেছেন।
বদলগাছী উপজেলার ভুক্তভোগী সহকারী শিক্ষক আব্দুল মতিন বলেন, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিত্বে বদলী করার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে বার বার তাগাদা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি আমার কাছে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবী করেন। বিষয়টি আমার পরিচিত এক ভাইকে জানানো হলে উল্টো শিক্ষা কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) আমাকে মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ভাবে হুমকি প্রদান করেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দিয়ে চাকরি খেয়ে নেয়ার হুমকি প্রদান করেন বলে অভিযোগ করেন।
বিলাশবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক আফতাব হোসেন বলেন, আমি রাজনীতি পরিবারের সন্তান এবং নিজেও রাজনীতি করি। নিয়নপুর স্কুলের জায়গা দখল করে স্থানীয় কয়েকজন যুবক দোকান করার প্রতিবাদে শিক্ষা অফিসে একটা দরখাস্ত দিয়। সেকারণে উপজেলা শিক্ষা অফিসার আতাউর রহমান স্যার আমাকে অফিসে ডেকে রাজনীতি করতে নিষেধ করেন এবং উল্টো চাকুরি খেয়ে নেয়া ও মামলা করার হুমকি দেন। এসব বিষয় নিয়ে স্যার বিভাগীয় অফিসে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছে। এ কারণে আমাকে গত মাসের ২৩ মার্চ নিয়নপুর স্কুল থেকে বিলাশবাড়ী স্কুলে বাড়ি থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে বদলি করা হয়েছে। কিন্তু আমি বদলির জন্য কোন আবেদন করিনি। অনেকে আবেদন করেও বদলি হতে পারছেন না।
বদলগাছী উপজেলায় জ্যেষ্ঠতার বিচার না করে বিধি বর্হিভ‚ত ভাবে শিক্ষকদের বদলী করা হয়েছে। এ চিত্র বদলগাছীসহ জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার।
গত রবিবার (৩১ মার্চ) বদলির ছিল শেষ দিন। জেলা শিক্ষা অফিসে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলার শিক্ষকদের ছিল উপচে পড়া ভিড়। তারা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সুপারিশ নিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসে এসেছিলেন। অফিসের অফিস সহায়কের কাছে বদলির আবেদনপত্র জমা দিয়ে স্মারক নাম্বার নেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আবেদনে স্মারক নাম্বার বসানোর পর শিক্ষকদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা ঘুষ নিচ্ছেন।
মান্দা উপজেলার এক শিক্ষিকার স্বামী গোলাম মোস্তফা বলেন, তার স্ত্রী খালেদা খানম উপজেলার ভারশোঁ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ওই স্কুল থেকে কালীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বদলির জন্য কাগজপত্র নিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসে এসেছিলাম। তার আবেদনপত্রে স্মারক নাম্বার বসানোর পর অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলাম পরিচিত হওয়ায় কিছু টাকা মিষ্টি খেতে দিয়েছেন। তবে অনান্যদের কাছ থেকে ৪/৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের অফিস সহায়ক সিরাজুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকরা খুশি হয়ে মিষ্টি খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিয়েছেন। আমি কারো কাছ থেকে জোর করে টাকা নিয়নি। এবিষয়ে তো কারো কোন অভিযোগও নাই।
বদলগাছী উপজেলা শিক্ষা অফিসার আতাউর রহমান বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী জেষ্ঠ্যতার ভিত্তিত্বে শিক্ষকদের বদলি করা হয়েছে। প্রকল্প থেকে যেসব শিক্ষক আসছেন তারা যোগদানের পর থেকে জ্যেষ্ঠতা বিবেচনা করা হয়েছে। এছাড়া ‘মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ বদলির জন্য আব্দুল মতিন আবেদন করেননি। আব্দুল মতিনকে হুমকি দেয়া হয়নি। তবে আমার যতটুকু ক্ষমতা ততটুকু বলা হয়েছে। ঘুষ দাবী করার বিষয়টি ভিত্তীহিন বলে দাবী করেন তিনি। এছাড়া বিভাগীয় অফিসের সুপারিশের ভিত্তিত্বে জেলার বাহির থেকে এক শিক্ষককে শেরপুর স্কুলে যোগদান করানো হয়েছে।
নওগাঁ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, আমার কাজ শুধু আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করা। আমি সে দায়িত্ব পালন করে আবেদনপত্র ছেড়ে দিয়েছি। এছাড়া ভুক্তভোগী কোন শিক্ষকের নিকট থেকে টাকা নেয়ার বিষয়টি নিয়ে কেউ কোন অভিযোগ করেননি।