রাঙ্গুনিয়ায় এক ভিক্ষুর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ

Loading

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় পদুয়া ইউনিয়নের ফালহারিয়ায় জঙ্গলের টিলায় এক ছদ্মবেশী স্বঘোষিত ভিক্ষুর বিরুদ্ধে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ও বনভূমি দখল, স্থানীয়দের ওপর নির্যাতন, হিন্দুদের শ্মশান উচ্ছেদ, মন্দির দখল, মুসলমানদের ধর্ম নিয়ে বিষোদ্গার, এমনকি মিয়ানমারের নাগরিকদের আশ্রয় দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

এসব নিয়ে শরণংকর ভিক্ষুর নামের এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা হয়েছে। এই ভিক্ষুর ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণে এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।

স্থানীয়রা জানান, এই স্বঘোষিত ভিক্ষু রনি ড্রাইভার নামেই পরিচিত ছিলেন।

প্রথমে হলুদ একটি কাপড় আর উপরে ত্রিপল দিয়ে শুরু করলেও পরে বেড়ার স্থাপনা, এরপর ইটপাথরের স্থাপনা শুরু করেন শরণংকর এবং ধীরে ধীরে সাত-আট বছরের ব্যবধানে ১০০ একরেরও বেশি জায়গা দখল করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্যের উন্নয়ন কর্মকান্ডে ফলাহরিয়া যাওয়ার দুর্গম রাস্তা সুগম হয়, শিলক নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ, কাঁচা রাস্তা পাকা করাসহ নানা কাজের ফলে ভিক্ষু শরণংকরের অনুদান প্রাপ্তির পরিমাণও বাড়তে থাকে।

অনুদান প্রাপ্তির সঙ্গে এই দখলযজ্ঞ চলতে থাকলে বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় হিন্দুদের শ্মশান নিয়ে এবং বিহার থেকে আড়াই কিলোমিটার আগে কালিন্দিরানী সড়কে মুসলমানদের জায়গার ওপর বুদ্ধমূর্তিসহ তোরণ স্থাপনকে কেন্দ্র করে মোসলমানদের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন শরণংকর।

স্থানীয়রা জানান, তারা ভেবেছিলেন, রাঙ্গুনিয়ার ফলাহরিয়ার পাহাড়ে ২০১২ সালে ছনের ছাউনি দিয়ে ছোট্ট একটি ঘর বানিয়ে থাকা শরণংকর (রনি ড্রাইভার) হয়তো কিছুদিন ধ্যান করে চলে যাবেন। কিন্তু তিনি আর যাননি। দিন দিন দখলকৃত ভূমির আয়তন বাড়ানো, বনবিভাগের জায়গায় টিনের ছাউনি দিয়ে ঘর বানানো, আশপাশের কয়েক একর বনভূমি দখল করেন। এর কিছুদিন যেতে না  যেতেই দখল করা বনভূমিতে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা শুরু করেন শরণংকর। এখন পর্যন্ত ১০০ একর বনভূমি দখল করে ‘জ্ঞানশরণ মহাঅরণ্য বৌদ্ধ বিহারের’ নাম দিয়ে  ছোটবড় বেশ কিছু বুদ্ধমূর্তি, ভিক্ষু-শ্রমণ ট্রেনিং সেন্টার, আবাসিক ভবন মিলিয়ে দুই ডজন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আশপাশের আরও অর্ধশতাধিক একর বনভূমি দখল করার প্রক্রিয়াও শুরু করেছেন। সেসব জায়গায় বন বিভাগের লাগানো লক্ষাধিক চারা গাছ শরণংকর ও তার সহযোগীরা রাতের আঁধারে কেটে  ফেলেছেন বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।

গত ৮ বছরে বনভূমির পাহাড় কেটে পাকা স্থাপনা, রাস্তা নির্মাণ ও অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ নেওয়া হলেও স্থানীয় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারেনি। প্রায় অর্ধ কোটি টাকা দামের গাড়িতে চড়েন তিনি।

সেই পাহাড়ে গড়ে তুলেছেন এক গোপন সাম্রাজ্য। তার বাস করা পাকা দালানটির অর্ধেকটা মাটির নিচে। দালানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটিও একেবারে কাছে না গেলে দেখা যায় না। পানি সরবরাহের জন্য লাইন ও পানির ট্যাংকও সেখানে আছে। প্রায় ২০টির মতো বৈদ্যুতিক সংযোগও ছিল যেগুলো অবৈধ বলে সম্প্রতি কাটা হয়েছে। জীবনের সব মোহমায়া-ভোগ বিলাস ত্যাগ করে সন্ন্যাস জীবন যাপন করছেন বলে কথিত ভিক্ষু বিপুল সম্পত্তি ভোগ করছেন। সেই ভিক্ষু শরণংকরের এই বাড়িটি পাহারা দিচ্ছে দুটো জার্মান শেফার্ড কুকুর।

মিয়ানমারের লোকজনকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর বিরুদ্ধে। পদুয়া ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান বলেছেন, আমরা প্রথমে শরণংকরকে সহযোগিতাই করেছি। কিন্তু পরে কথাবার্তা আর চালচলনে সন্দেহ বাড়তে থাকে। পাহাড়ের ওপরে আন্ডারগ্রাউন্ড ঘর বানানো হয়েছে। কেউ সেখানে যেতে পারে না। কিছুদিন আগে মিয়ানমারের নাগরিকরা তার বিহারে এসেছিল। পদুয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. বদিউজ্জামান বলেন, তার (শরণংকর) প্রধান উদ্দেশ্য জমি দখল করা। তিনি মিয়ানমার থেকে ভিক্ষু এনে এখানে স্থাপনা তৈরি করেছেন। সেটা আমাদের ও দেশের জন্য হুমকি।

তবে শরণংকর থেরো এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তার বিহারে তল্লাশি করে দেখা হোক। আর গাড়ির কথা জানতে চাইলে শরণংকর ভিক্ষু বলেন, গাড়ি চড়তে তো নিষেধ নেই।

সম্প্রতি দুর্গাপূজার আগেই শ্মশান ও রাধাকৃষ্ণ মন্দির দখলকারী ভিক্ষু শরণংকরকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী ঐক্য পরিষদের নেতারা। শুধু রাঙ্গুনিয়া আর চট্টগ্রামেই নয়, ঢাকাতেও মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন তারা। আল্লাহ ও রসুলকে (সা.) কটাক্ষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মবিদ্বেষী প্রচার, বলপ্রয়োগে মন্দির, শ্মশান ও বনভূমি দখলের দায়ে চট্টগ্রামের কথিত ভিক্ষু শরণংকরকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন দেশের আলেম-ওলামারাও।

ফলাহারিয়া গ্রামের শাহ সুফি পাঠান আউলিয়া মাজারের মুতওয়াল্লি এবং পাঠান আউলিয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ হাকিম উদ্দিন বলেন, দীর্ঘদিন পর্যন্ত মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ সবাই সম্প্রীতির মাধ্যমে আমরা বসবাস করে আসছি। ৭-৮ বছর আগে হাটহাজারী উপজেলার শরণংকর ভান্তে এখানে এসেছেন। তিনি এই এলাকায় বহিরাগত। তিনি আসার পর থেকে উনার বিভিন্ন কার্যক্রমে আমাদের এখানে বড়ুয়া-মুসলমানদের সম্প্রীতি নষ্ট হতে যাচ্ছে। সারা দিন তিনি মাইক ব্যবহার করেন, এতে স্কুল-মাদ্রাসার পড়ালেখার ক্ষতি হয়। যেদিকে আমরা হাঁটাচলা করি সেদিকে তিনি মূর্তি বসান।

তিনি বলেন, আবদুল গফুর, মুছা, হাজেরা বেগমদের জায়গা জোরপূর্বক দখল করে বিহারের গেট করেছেন শরণংকর। গফুরের বাগানটা তিনি কেটে দিয়েছেন। সেখানে ঘর ছিল, সেটাও ভেঙে দিয়েছেন। বিহারে আগতদের মধ্যে প্রায় সবাই বহিরাগত, অচেনা। স্থানীয়রা শরণংকর ভান্তের বিহারে কম যান। মিয়ানমার থেকেও বিভিন্ন মানুষজন শরণংকর ভান্তের কাছে আসেন।

মুহাম্মদ হাকিম উদ্দিন বলেন, শরণংকর ভান্তের শত একর জায়গা দখল করা নিয়ে আমরা বন বিভাগের কাছে গিয়েছি, সেখানে প্রতিকার পাইনি। পুলিশ প্রশাসনের কাছে গিয়েছি, তারাও কিছু করেনি। শেষ পর্যন্ত আমরা তথ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়েছি, উনাকে বিস্তারিত বলেছি। তিনি স্থানীয়ভাবে মেম্বার/চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন।