আপেল মাহমুদ, নওগাঁ প্রতিনিধি : অগ্রহায়ণের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই আমন ধানের কাটামাড়াই শেষ। মাঘের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হবে বোরো ধানের চারা রোপণের কাজ। মাঝখানে অন্তত: ৭৫ থেকে ৮০ দিন পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে জমি। দীর্ঘ এ সময় কাজে লাগিয়ে কৃষকরা শুরু করেছেন সরিষার চাষ। বাড়তি ফসল হিসেবে এ চাষে ক্রমেই আগ্রহ বাড়ছে তাদের।ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় এ অঞ্চলের মাঠের চিত্র। এক সময়ের সবুজ মাঠ হয়ে যায় হলুদ। এবারের শীতে সরিষা ফুলের নয়নাভিরাম দৃশ্য পাল্টে দিয়েছে নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ফসলের মাঠ। এ মৌসুমে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চাষ হয়েছে সরিষার। চারিদিকে এখন শুধু হলুদ সরিষা ফুলের বর্ণিল সমারোহ।
মাঠের পর মাঠজুড়ে সরিষা ফুলের মৌ-মৌ গন্ধ। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে একদল মৌ-খামারী। সরিষা ফুলের রেণু থেকে মধু সংগ্রহে এসব মাঠে স্থাপন করা হয়েছে একাধিক মৌ-খামার। স্থাপনকৃত এসব খামারেই মধু মাড়াই করে পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। অনুকুল আবহাওয়ায় ভাল লাভের আশা করছেন খামারীরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় ৫ হাজার ৯০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪৫ হেক্টর জমিতে স্থানীয় জাতের সরিষার চাষ হয়েছে। এছাড়া ২ হাজার ১৫ হেক্টর জমিতে টরি-৭, ২ হাজার ৮৭৫ হেক্টর জমিতে বারি-১৪ এবং ১৫৫ হেক্টর জমিতে বারি-১৫ এর চাষ করেছে কৃষক। আবহাওয়া অনুকুল হলে এ চাষ থেকে ৯ হাজার ১৬২ মেট্রিকটন সরিষা উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপজেলার ফতেপুর গ্রামের কৃষক ইব্রাহীম হোসেন এবারে ২০ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছেন। একই গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ ১০ বিঘা, ছোটমুল্লুক গ্রামের কহিম উদ্দিন শাহ্ ৭ বিঘা, ভারশোঁ গ্রামের মোজাফফর হোসেন ৬ বিঘা ও আব্দুল লতিফ ৫ বিঘা জমিতে এ আবাদ করেছেন। এসব কৃষকরা বলেন, আমন ও বোরো ধানের মাঝখানে দীর্ঘ সময় জমি পতিত অবস্থায় পড়ে থাকে। এসময় বাড়তি ফসল হিসেবে আমরা সরিষার চাষ করেছি। তারা বলেন, বাড়তি এ আবাদ থেকে বাড়তি আয় হচ্ছে। সরিষা বিক্রির টাকা আমরা বোরো আবাদে ব্যয় করছি। এখন দোকান থেকে আর বাঁকিতে সার ও কীটনাশক কিনতে হচ্ছে না। সরিষার কাঁটাও জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
অন্যদিকে চলতি মৌসুমে সরিষার মাঠে স্থাপন করা হয়েছে সাড়ে ৮ শতাধিক মৌ-বক্স। এর মধ্যে সর্বাধিক মৌ-খামার রয়েছে কালিকাপুর ইউনিয়নের কয়েকটি মাঠে। এসব মৌ-খামারে রয়েছে ৪০ থেকে ১৫০টি মৌ-বক্স। খামারীরা মাঠেই মধু মাড়াই করে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছেন। আবহাওয়া অনুকুল হওয়ায় বিগত বছরের তুলনায় এবারে মধু আহরনের পরিমাণ বেশি হবে বলে জানিয়েছেন খামারীরা।
উপজেলার ফতেপুর মাঠে স্থাপনকৃত মৌ-খামারের মালিক রাজশাহী শহরের বাসিন্দা রাম্মান আরেফিন রিমন জানান, ‘১৯৯৫ সাল থেকে আমি এ পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। শুরুতে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছিল। মৌমাছি সংরক্ষণ ও উৎপাদনে তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। পরবর্তীতে এবিষয়ে কয়েকবার প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এখন সফলতার সঙ্গে মধু উৎপাদন ও বাজারজাত করছি। রাজশাহী শহরের কয়েকটি বিপনী বিতানসহ অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘দারাজ’ এর মাধ্যমে মধু বিক্রির কাজ করে আসছি।’
সফল এ খামারী আরও বলেন, ‘ সরিষা, কালোজিরা, লিচু মৌসুমসহ বছরের ৬ মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মৌ-খামার স্থাপন করে মধু সংগ্রহের কাজ করি। অফসিজনে বাড়িতে মৌমাছি সংরক্ষণের কাজ করে থাকি। রানী মাছি তৈরিতে একটু বেগ পেতে হয়। এসময় পরাগরেনু, ভুট্টা, বেশম মিশ্রিত খাবার দিতে মৌমাছির চাহিদা পুরন করা হয়ে থাকে।’
উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান জানান, চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদ বাড়ানোর লক্ষে ১ হাজার ২৫০ জন কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে প্রণোদনার সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে। স্বল্প খরচ ও স্বল্প সময়ের এ আবাদ থেকে কৃষক বাড়তি আয় করতে পারেন। এ আয় ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করবে।
কৃষি কর্মকর্তা আরও বলেন, সরিষার ক্ষেতে মৌ-খামার স্থাপন করে মধু সংগ্রহ করছেন খামারীরা। খামারের মৌমাছিরা মধু সংগ্রহের কাজে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে ছুটে বেড়াচ্ছে। এতে পরাগায়নে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে মৌমাছিরা। এ কারণে মৌ-খামার স্থাপনকৃত এলাকায় সরিষার ফলন ২০ শতাংশ হারে বাড়বে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, চলতি মৌসুমে সরিষার ১৪টি প্রদর্শনীর প্লট স্থাপনসহ ৬ জন কৃষককে উন্নতমানের মৌ-বক্স দেয়া হয়েছে। যাতে কৃষকরা সরিষা উৎপাদনের পাশাপাশি মধু সংগ্রহ করে তারা বাড়তি আয় করতে পারেন।