ঠাকুরগাঁওয়ে র্যাফেল ড্র’র ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ গ্রামের অলিগলি, শহর, হাট-বাজারগুলোতে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ‘মাথাই নষ্ট মামা। প্রতিদিন কয়েকটি দামি মোটরসাইকেলসহ কয়েক লাখ টাকার পুরস্কার। ভাগ্যে থাকলে আপনিও পেয়ে যেতে পারেন লোভনীয় পুরস্কার। ’র্যাফল ড্র’র টিকিট বিক্রির জন্য এভাবে মাইকিং করা হচ্ছে।
র্যাফেল ড্র’র প্রতারণা চলছে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলায়। মানুষকে পুরস্কার জেতার স্বপ্ন দেখাচ্ছে আনন্দমেলার আয়োজকেরা। নিম্ন আয়ের মানুষ ও শিক্ষার্থীরা সহজেই তাদের এই ফাঁদে পা দিচ্ছে।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের বহমতোল এলাকায় গত ১৫ জানুয়ারি থেকে চলছে আনন্দমেলা। ২৩ জানুয়ারি থেকে ওই মেলায় শুরু হয়েছে র্যাফল ড্র। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘দৈনিক সবুজ বাংলা র্যাফল ড্র’।
মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ভাঙিয়ে মেলার আয়োজক স্থানীয় একদল তরুণ। আয়োজকেরা দিনের বেলা মূল্যবান ও আকর্ষণীয় পুরস্কার দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মাইকিং করছে। রাতের বেলা ড্রয়ে কিছু না জুটলেও দমছে না তারা।
ভাগ্য জয়ের আশায় আবারও টিকিট কিনছে মানুষ। এভাবে যত টিকিট বিক্রি হচ্ছে, তত পকেট ভারী হচ্ছে আয়োজকদের। এতে পকেট খালি হচ্ছে সাধারণ মানুষের। বৃহস্পতিবার রাত থেকে এখানে হাউজির নামে জুয়া খেলা শুরু করার চেষ্টা চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। মেলায় হাউজির জন্য বানানো হয়েছে প্যান্ডেলও।
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুস সোবহান বলেন, মেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
জেলা প্রশাসন বলছে, তারা বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার পাড়িয়া ইউনিয়নের বহমতোল এলাকায় ২২ জানুয়ারি হতে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৮ দিনের জন্য শুধু গ্রামীণ শিল্পসামগ্রী মেলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের র্যাফল ড্র বা হাউজির অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ড. কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, সাধারণত মেলায় হাউজি-র্যাফল ড্রয়ের অনুমতি দেওয়া হয় না। লাহিড়ীহাট মেলায়ও দেওয়া হয়নি। এরপরও খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার মেলা চত্বরে গিয়ে দেখা গেছে, মেলায় চার-পাঁচটি দোকান বসানো হয়েছে। বিনোদনের জন্য বসানো হয়েছে সোনালী অপরো নামে একটি যাত্রার প্যান্ডেল। পাশে রয়েছে ‘৩টি’ ভ্যারাইটিজ সার্কাসের প্যান্ডেল। যেগুলোতে নিয়মিত দেখানো হচ্ছে অশ্লীল নৃত্য। তবে মেলায় র্যাফল ড্র আর হাউজিই মূল আকর্ষণ।
স্থানীয় লোকজন বলেন, র্যাফল ড্রয়ের প্রতিটি টিকিটের দাম ২০ টাকা। টিকিট বিক্রি করতে প্রতিদিন সকালে মেলা চত্বর থেকে ১৫০টিরও বেশি ইজিবাইক ছুটছে উপজেলা সদরসহ আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন স্থানে। প্রতিদিন অন্তত ৫০ থেকে ৬০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন ৭ থেকে ১১ লাখ টাকার টিকিট বিক্রি হয়। রাত সাড়ে ১০টায় শুরু হয় র্যাফল ড্র। র্যাফেল ড্র সরাসরি স্থানীয় ক্যাবল টিভিতে সম্প্রচার করা হচ্ছে।
জানা গেছে, র্যাফল ড্র’র দামি পুরস্কার হিসেবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তিনটি মোটরসাইকেল দেওয়া হয়। ওই তিনটি মোটরসাইকেলের দাম পড়ে সর্বোচ্চ ৪ লাখ টাকা। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে আছে বাইসাইকেল, শাড়ি, লুঙ্গি, মুঠোফোন, বৈদ্যুতিক পাখা প্রভৃতি। এসব কিনতে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মতো খরচ হয়। সে হিসাবে মেলার র্যাফল ড্র’র পেছনে আয়োজকদের খরচ সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা। সে অনুযায়ী সব খরচ বাদে আয়োজকদের প্রতিদিন ৩-৪ লাখ টাকা লাভ হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চৌরাস্তা বাজারে ইজিবাইকে করে র্যাফল ড্র’র টিকিট বিক্রি করছিলেন রশিদুল ইসলাম। তিনি তালিকা দেখিয়ে বলেন, ‘আজকে (বৃহস্পতিবার) পুরস্কার হিসেবে থাকবে দামি দামি পুরস্কারসহ ৩টি মোটরসাইকেল।
গত বুধবার প্রথম পুরস্কার ১টি মোটরসাইকেল ও শেষে ১টি মোটরসাইকেলসহ ৪৫টি পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে পুরস্কারের সংখ্যা বাড়বে। প্রতিদিন তিনি ইজিবাইকে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে আড়াই থেকে চার হাজার টিকিট বিক্রি করেন।
কালমেঘ হাট এলাকায় ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান সাইদুর রহমান। বৃহস্পতিবার মেলা প্রাঙ্গণের সামনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মেলায় র্যাফেল ড্র শুরুর দিন থেকে প্রতিদিন ১০টা করে টিকিট কিনেছু। প্রতিদিন তিনটা মোটরসাইকেলসহ ৪৫টা পুরস্কার দিলেও মোর ভাগ্যে কিচ্ছু জুটিলনি। এ পর্যন্ত প্রায় ১৬০০ টাকার টিকিট কিনছু। ’
গত বৃহস্পতিবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ইজিবাইক থেকে টিকিট কিনছিল পাড়িয়া এলাকার স্কুলশিক্ষার্থী আব্দুল্লাহি সাফি। সাফি জানায় ‘প্রতিদিন পরিবারের সকলে ১টি করে মোট ৫টি টিকিট কিনছি, তবে পুরস্কার পাইনি’।
বাদামবাড়ী হাট এলাকার বাসিন্দাশরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পুরস্কারের লোভে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষেরা তাদের আয়ের বড় অংশ লটারির টিকিট কিনে শেষ করছে। এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত বাড়ি থেকে চুরি করে টাকা নিয়ে সেই টাকায় লটারি কিনছে। ’
উল্লেখ, মেলা ও র্যাফেল ড্র কেন্দ্রে করে ইতোমধ্যে পাড়িয়া বাজারে সাধারণ মানুষ ও মেলা কমিটির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এতে হামিদুর রহমান নামের একজন লোকের পা ভেঙেছে এবং তার ছেলে লাল চান গুরুতর আহত হয়ে বর্তমানে বালিয়াডাঙ্গী হাপসপাতালে ভর্তি রয়েছে।
বালিয়াডাঙ্গী থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করলেও কোনো পক্ষই অভিযোগ দেয়নি বলে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বালিয়াডাঙ্গী থানার ওসি মোসাব্বেরুল হক।