‘কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল সেকশন পুনর্বাসন’ প্রকল্পে দীর্ঘ ৭ বছরে অগ্রগতি মাত্র ১৫ শতাংশ

Loading

জিতু তালুকদার,মৌলভীবাজার ঃ ‘কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেল সেকশন পুনর্বাসন’ প্রকল্পের কাজ দীর্ঘ ৭ বছরের বেশী সময়ে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। চলতি বছরের জুন মাসে প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় আরেক দফা মেয়াদ বৃদ্ধি করা হলেও যে শম্ভুক গতিতে কাজ চলছে, তাতে বর্ধিত মেয়াদেও কাজ শেষ হবে কি-না এ নিয়ে সংশয় রয়েছে।
জানা যায় বন্ধ হয়ে যাবার প্রায় দেড় দশক পর কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইনটি নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু, সে উদ্যোগেও ছিল শম্ভুক গতি। এ সংক্রান্ত ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন’ নামের প্রকল্পটি গ্রহণের পর পেরিয়ে গেছে ৭ বছরের বেশি সময়। কিন্তু, চলতি বছরের জানুয়ারী পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ভৌত অগ্রগতির পরিমান মাত্র ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।

৭ বছরের বেশি সময়ে ব্যয় হয়েছে ৬৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ইতিমধ্যেই প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক পর্যালোচনায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের এ করুণ চিত্র উঠে আসে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রকল্পের বিপরীতে পরামর্শক নিয়োগ, ডিটেইলড ডিজাইন ও টেন্ডারিং সার্ভিস ইত্যাদি কাজ সম্পাদনে বিলম্ব হয়েছিল।

ফলে প্রকল্পের মূল কাজ তথা পূর্ত কাজ সম্পাদনের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৫ নভেম্বও ২০১৭ সালে। এছাড়া প্রথম দিকে মূল প্রকল্পটি সরকারের নিজস্ব তহবিলের অর্থে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থাকলেও পরে ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এছাড়া প্রথমে মিটার গেজ রেললাইন তৈরির কথা থাকলেও পরে ব্রডগেজ রেললাইন তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এসব ছাড়াও পরামর্শক নিয়োগে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের মতামত পেতেই ৬ মাস সময় লেগে যায়। এরকম নানা জটিলতায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১১ সালে যখন প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয় তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সেসময় সরকারের নিজস্ব তহবিলের অর্থেই বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু পরে ২০১৫ সালে বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে কানেকটিভিটির আওতায় কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনে (পুনর্বাসন প্রকল্প সংশোধিত) ফের ট্রেন চালুর লক্ষ্যে মে মাসের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে লক্ষ্যে ব্যয় বাড়িয়ে ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা করা হয়। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১২২ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং প্রথম ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণ থেকে ৫৫৫ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়।

পরে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে এ প্রকল্পেরও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কিন্তু নানা জটিলতায় এখনও বাস্তবায়নের মূল কাজ প্রায় শুরুই হয়নি। অন্যদিকে মূল প্রকল্পটি ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। সেটি সম্ভব না হওয়ায় ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।

এ সময়ের মধ্যেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্পে রেললাইন পুননির্মাণ, রেলস্টেশনের ভবন সংস্কার, সংকেত-ব্যবস্থার উন্নতিসহ ৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেললাইন আধুনিকায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এগোয়নি। পরে ২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বড়লেখা সফরকালে বড়লেখা ডিগ্রি কলেজ মাঠে আয়োজিত জনসভায় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য রেললাইন চালুর দাবি জানালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে রেললাইনটি চালুর ঘোষণা দেন।

কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথটির দৈর্ঘ্য ৫২ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার। এটি ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ জেলার সাথে যুক্ত। এ রেলপথে কুলাউড়া, জুড়ী, দক্ষিণভাগ, কাঁঠালতলী, বড়লেখা, মুড়াউল ও শাহবাজপুর নামে ৬টি স্টেশন রয়েছে। ডুয়েল গেজের ৬টি রেলস্টেশনের মধ্যে চারটি ‘বি’ ও দুটি ‘ডি’ শ্রেণীর হবে। রেলপথটিতে ১৭টি বড় সেতু, ৪২টি ছোট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। ভারতের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘কালিন্দি রেল নির্মাণ’ দরপত্রের মাধ্যমে এ কাজটি পায়। এ ছাড়া প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে ভারতের ‘বালাজি রেল রোড সিস্টেমস’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান। সরেজমিনে দেখা গেছে, রেলপথের শাহবাজপুর স্টেশনের কাছে কিছু স্থানে পুরোনো রেল সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ওই এলাকার কিছু স্থানে রেলপথের মাটি সরিয়ে নতুন করে মাটি-বালি ফেলা হচ্ছে। কয়েকটি বড় ও ছোট সেতু ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। ১-২টিতে নির্মাণ সামগ্রী ফেলা হলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। বর্ধিত মেয়াদ ২০২০ সালের মে মাসে প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হবার কথা থাকলেও গত ৮ আগস্ট থেকে প্রকল্প এলাকায় রেলট্র্যাক মজুদ শুরু করা ছাড়া তেমন কোন অগ্রগতি নেই কাজে।

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কার্যাদেশ অনুযায়ী ১ বছরে ৫২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হবার স্থলে সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ১৪-১৫ শতাংশ। গত ১৫ মে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাশ সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে কাজের ধীর গতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী ও রেলওয়ের ঢাকার প্রধান দপ্তরের বিভাগীয় প্রকৌশলী- ২ আহসান জাবির জানান, কাজে এখনো আশানুরুপ অগ্রগতি নেই। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে বার বার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রেলওয়ের কলসালটেন্ট মো. এমদাদ হোসেন জানান, কাজে অগ্রগতি না থাকায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কোন বিল দেয়া হচ্ছেনা। কাজের গতি বাড়ানোর জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হচ্ছে। তবে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী মি. মুখেশ (ভারতীয়) জানান, বৃষ্টির জন্য কাজে ব্যাঘাত ঘটে। সেপ্টেম্বর থেকে দ্রæত কাজ চলবে। তিনি জোর দিয়েই বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হবে।